একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে মাঠে চায় বিএনপি। বিশেষ করে পদে থেকে আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে দলটি।
আন্দোলনে না থেকে শীর্ষ নেতাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। ঢাকায় থেকে বলছেন তার অবস্থান এলাকায়। আন্দোলনের পুরোনো ছবি পাঠানোর নজির মিলেছে। এ ধরনের নেতাদের তালিকা করা হচ্ছে। মাঠে না থাকলে তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা।
ইতোমধ্যে সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলায় দায়িত্বে থাকা নেতাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোকেও। আন্দোলনে অনুপস্থিত থাকার কারণে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিটের সাত নেতার পদ সাময়িক স্থগিত করেছে ছাত্রদলও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্রমতে, চলমান আন্দোলন সফল করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ড। বিএনপিসহ অঙ্গ-সহযোগী নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
গ্রেফতার এড়িয়ে রাজপথে কর্মসূচি পালনসহ দেওয়া হচ্ছে নানা নির্দেশনা। ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে একদিন হরতাল ও পাঁচ দফা অবরোধ কর্মসূচির মূল্যায়নও চলছে। সিনিয়র নেতাদের পর্যবেক্ষণ, সাংগঠনিক জেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের তৎপরতা খুব বেশি দেখা যায়নি। অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ভূমিকা ছিল।
আজ থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। এ কর্মসূচিসহ আগামী দিনের আন্দোলনে বিএনপির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে মাঠে নামার জন্য বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচিতে আছে বিএনপি। যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, নেতাকর্মীরা সেভাবেই পালন করছেন। সামনের দিকে কর্মসূচিতে সক্রিয়তা বাড়াতে নির্দেশনা আছে। বন্দুক ও নির্যাতনের মধ্যেও জীবনবাজি রেখে নেতাকর্মীরা আন্দোলন সফল করবেন।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছে। নেতাকর্মীদের সক্রিয়ভাবে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা রয়েছে। যার যার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আন্দোলন সফলের বার্তা দেওয়া হয়েছে।’
জানা যায়, কয়েকটি জেলার শীর্ষ নেতারা এখনো নিষ্ক্রিয় আছেন। এমনকি তাদের মোবাইল ফোনেও সময়মতো পাওয়া যায় না। যে কারণে সংশ্লিষ্ট জেলার তৃণমূল নেতারা একধরনের অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। এসব জেলা চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব নিষ্ক্রিয় থাকায় সেখানে যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিবকে চলমান রাজনৈতিক কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।
হাইকমান্ডের নির্দেশনা পেয়ে আন্দোলনে অনুপস্থিত থাকার কারণে শুক্রবার ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর পূর্ব শাখার বিভিন্ন ইউনিটের সাত নেতার পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়। তারা হলেন নিউ মডেল কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. ইব্রাহিম, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সদস্যসচিব ফিহান মাহদিয়াল আলম, খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক রেজাউল করিম সুজন, হাজারীবাগ থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রাশিদুল্লাহ সিদ্দিক রাশেদ, যুগ্ম-আহ্বায়ক তানজিল ইসলাম, নিউমার্কেট থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও মতিঝিল থানার যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল পারভেজ।
তাদের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে থেকেও চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ও অসহযোগিতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পদ সাময়িক স্থগিত করা হলো। পরবর্তী কর্মসূচিগুলোয় তাদের উপস্থিতি/সহযোগিতা পর্যবেক্ষণপূর্বক যদি তা গ্রহণযোগ্য এবং সন্তোষজনক হয় তবে পুনরায় স্বপদে বহাল করা হবে। অন্যথায় স্থায়ীভাবে পদ স্থগিত করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। একইভাবে অন্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনও নিষ্ক্রিয়দের তালিকা করছে।
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কয়েকটি জেলার কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হাইকমান্ড। সূত্র জানায়, আন্দোলনে মাঠে না থেকে কিছু জেলার নেতাকর্মী কেন্দ্রকে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। কর্মসূচি পালন করলে তার ছবি অথবা ভিডিও দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু হরতাল ও অবরোধে মাঠে না থেকে অনেক আগের কর্মসূচি পালনের ছবি পাঠানো হচ্ছে।
এমনকি একদিন বিক্ষোভ করেছে, পরে একই ছবি পরের কর্মসূচির বলেও পাঠানো হচ্ছে। এ নিয়ে বিব্রত দায়িত্বশীল নেতারা। কয়েকটি জেলার নেতাদের ইতোমধ্যে সতর্কও করা হয়েছে।
দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, জামালপুরের একটি আসনে কেন্দ্রীয় একজন সম্পাদকের নির্দেশে মিছিল হয়েছে এবং সেই ছবি কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেই আসনটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অথচ কেন্দ্রে পাঠানো ছবিতে দেখা গেছে ছবিটির পেছনে ফ্লাইওভার। প্রত্যন্ত এলাকায় ফ্লাইওভার দেখে সন্দেহ হলে ওই নেতাকে মিথ্যা তথ্য না দিতে সতর্ক করা হয়। এ রকম আরও ছবি পাওয়া গেছে, যা চলমান আন্দোলনের নয়।
এ ছাড়াও কয়েকটি জেলার নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। উদাহরণ টেনে বলেন, সম্প্রতি পিরোজপুর জেলার সদস্যসচিব ঢাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। অথচ ওই নেতা যেদিন রাতে জানিয়েছিলেন তিনি পিরোজপুরে থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, পরদিন সকালে ঢাকা থেকে গ্রেফতার হলেন। এর মানে, ওই নেতা ঢাকায় থেকেই হাইকমান্ডকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তিনি নিজ এলাকায় আছেন। দল যখন চূড়ান্ত আন্দোলনে, তখন এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যারা সাংগঠনিক ও আন্দোলন তদারকির দায়িত্বে, তাদের এলাকায়ই কোথাও কোনো কর্মসূচি পালন হচ্ছে না, অথবা নামমাত্র দু-একদিন হচ্ছে। ১০ সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্বে থাকা অধিকাংশ সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ঢাকায় অবস্থান করছেন। কয়েকজনের ফোনও বন্ধ। আবার অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলারও শীর্ষ নেতা ঢাকায় অবস্থান করছেন। তারা নিজ জেলার নেতাকর্মীদের খোঁজ পর্যন্ত রাখছেন না।
জেলাগুলোয় বিএনপির নেতাকর্মীরা নিজ উদ্যোগে কর্মসূচি পালন করছেন। তবে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা সারা দেশে অনেক সক্রিয়। তারাই মূলত আন্দোলন সফল করছেন। কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ে যথাসময়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তারা (জেলার শীর্ষ দুই নেতা) আবার তৃণমূলে তা পৌঁছে দিচ্ছেন।
আন্দোলন সফলে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সঠিক সমন্বয় থাকলেও বিএনপির ক্ষেত্রে এর উলটো। সমন্বয়হীনতার কারণে যথাসময়ে সঠিক নির্দেশনা পাচ্ছেন না তৃণমূল নেতারা। যদিও কেন্দ্র বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা। তারা জানান, কিছু জেলায় সমস্যা আছে, তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী দিনে তাদেরকেও মাঠে সক্রিয়ভাবে দেখা যাবে।