সম্প্রতি একজন গর্ভবতী মায়ের ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয় কুমিল্লায়। সন্তানসম্ভবা ওই নারীকে স্থানীয় চিকিৎসকরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। দেখতে পান জটিল পরিস্থিতি। এরপর কালবিলম্ব না করে গুরুতর অবস্থায় ওই ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রোগীর স্বামী জানান, গত ১৬ই আগস্ট তার স্ত্রীর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে কুমিল্লা থেকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করান। চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। পাঁচ দিনে রোগীর পেছনে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ৪০ হাজার টাকার উপরে। তিনি বলেন, রক্তের প্লাটিলেট দিতে খরচ হয় বেশি। তারপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
ডেঙ্গু আক্রান্ত আরেক রোগী জয়নাল আবেদিন খান। ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে এসে রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ দুই নম্বর সড়কের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২৭শে আগস্ট ভর্তি হয়েছেন। রোগীর এক স্বজন জানান, হাসপাতালে ভর্তির প্রথম দিনেই ২৫ হাজার টাকার উপরে ব্যয় হয়েছে। ক্ষোভের সঙ্গে ওই স্বজন বলেন, দেশে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নিয়ে রীতিমতো বাণিজ্য হচ্ছে। পদে পদে খরচ।
এদিকে, ডেঙ্গু রোগীর চাপে রাজধানীর অনেক সরকারি হাসপাতালেই বিছানা ফাঁকা নেই। আবার বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা নিতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। প্রতিদিন প্লাটিলেট পরীক্ষা, ডেঙ্গু শনাক্তের টেস্ট, সিভিসিসহ অন্যান্য পরীক্ষায় যাচ্ছে অনেক টাকা। অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের একাধিক সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় সবার খরচ মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। রোগী প্রতি গড়ে সরকারি কোষাগার থেকে গিয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে সেবা নেয়া মোট রোগীর ৭০ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগী এক লাখ ১৬ হাজারের কিছু বেশি। বাকি ৩০ শতাংশ বা ৩৪ হাজার ডেঙ্গু রোগী বেসরকারিতে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে ধরে নেয়া যায়। বেসরকারি হাসপাতালে গড়ে একজন রোগী ১ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করছেন সেই হিসাবে হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে এই রোগীদের। সরকারি হাসপাতালে যেখানে নিজস্ব দাতার কাছ থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট নিতে খরচ হয় ২ হাজার টাকার মতো, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় নেয়া হচ্ছে ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।
এবার ধনী-গরিব নির্বিশেষে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। রাজধানীর সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিকৃত ডেঙ্গু রোগীদের বেশির ভাগ নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে এসব খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন বিপাকে। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন রোগীর স্বজনরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ক্রিটিক্যাল ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালেও ১ লাখ টাকার উপরে ব্যয় হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় আর কয়েকগুণ বেশি। সুযোগ বুঝে বেড়েছে স্যালাইন, স্যালাইন দেয়ার অনুষঙ্গ ক্যানোলা ও মাইক্রোপ্রোসর (ক্যানোলা স্থাপনে ব্যবহৃত বিশেষ টেপ) দামও। রক্তের ব্যাগের দামও বেড়েছে। এতে চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গু চিকিৎসায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো দু’ভাবে প্লাটিলেট বাণিজ্য করছে। প্রথমত, ডেঙ্গু হলেই প্লাটিলেট লাগবে- এমন একটি ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্মেছে। এই ধারণাকে পুঁজি করে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেসব রোগীর প্লাটিলেট প্রয়োজন না, তাদেরও প্লাটিলেট দিচ্ছে। আবার প্লাটিলেট দিতে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ গুণ টাকা নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাটিলেট দু’ভাবে সংগ্রহ করা যায়। সিঙ্গেল ডোনার প্লাটিলেট ও র্যান্ডম ডোনার প্লাটিলেট। সিঙ্গেল ডোনার প্লাটিলেট প্রক্রিয়ায় একজন দাতার শরীর থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হয়। সরকারি হাসপাতালে এই প্রক্রিয়ায় প্লাটিলেট নিতে একজন রোগীর ব্যয় হয় মাত্র ২ হাজার টাকা। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো সিঙ্গেল ডোনার প্লাটিলেট ব্যবস্থাপনায় ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ফি নিচ্ছে।
র্যান্ডম ডোনার প্লাটিলেট প্রক্রিয়ায় চারজন দাতার রক্ত নিয়ে এক ব্যাগ প্লাটিলেট তৈরি করা হয়। সরকারি হাসপাতালে এই প্রক্রিয়ায় প্লাটিলেট পেতে শুধু স্ক্রিনিং ও ক্রস ম্যাচিং ফি দিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে রক্তের ব্যাগ না থাকলে সেই দামটি ফি’র সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু বেসরকারিতে চার দাতার রক্ত পরিসঞ্চালনেই রোগীর ব্যয় হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় ডোনার স্ক্রিনিং ও ক্রস ম্যাচিং ফি।
আর প্রতি ব্যাগ রক্ত থেকে প্লাটিলেট বের করতে দিতে হয় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ চার ব্যাগ রক্ত থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট পেতে রোগীর ব্যয় হয় ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেবে আরও দিতে হয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। ডেঙ্গু রোগীদের প্লাজমার ক্ষেত্রেও একই ব্যয় হয়ে থাকে। তবে প্লাজমা খুব কমসংখ্যক রোগীর লাগে। যাদের প্লাজমা ক্ষরণ হয়, তাদের চিকিৎসায় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট ও রক্তদানকে গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
সরকারি হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ব্যয় বাড়াতে প্রথম থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনে অ্যালবুমিন প্রয়োগ করে। এতে রোগীর চিকিৎসার ব্যয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেড়ে যায়। একটি অ্যালবুমিনের দাম ৭ হাজার ৬০০ টাকা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেসরকারিতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষা এনএস-১ ও আইজিজি-আইজিএম ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সিবিসি পরীক্ষার ফি ৪০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য জিনিসের দাম কয়েকগুণ বেশি নেয় হাসপাতালগুলো।
চিকিৎসকরা বলেন, রোগীর শরীরে স্যালাইন ঢোকানোর জন্য ক্যানোলা ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ায় উৎপাদক ও সরবরাহকারীরা ক্যানোলার দাম বাড়িয়েছে। আগে ক্যানোলার যে সেটের দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন সেটি ১৫০ টাকা। এর সঙ্গে দাম বেড়েছে ক্যানোলা স্থাপনে ব্যবহৃত বিশেষ টেপ। আগে এর দাম ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এখন তা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।
ডেঙ্গু রোগীর রক্তের প্লাটিলেট পরীক্ষা দিনে ৩ থেকে ৪ বারও করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও নানা ধরনের পরীক্ষা করতে হচ্ছে রোগীর। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করা গেলেও বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হচ্ছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। এতে ব্যয় বাড়ছে চিকিৎসার। এই ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। সেখানে শয্যা ভাড়া, চিকিৎসকের ভিজিট, ওষুধসহ নানা খরচে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। ডেঙ্গু রোগীর পথ্যের দামও বেড়ে গেছে বলে রোগীর স্বজনরা জানান। তারা বলেন, ডাবের দাম এখন আকাশচুম্বী। একটি ডাব কিনতে ১শ’ টাকা লাগছে। এ ছাড়া পেঁপে, মাল্টাসহ বিভিন্ন ফলও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে জানান তারা।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা হয় দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সব জায়গায় দুর্নীতি। গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে। সরকারি হাসপাতালেও স্যালাইন পাওয়া যায় না। সিট না পেয়ে ফ্লোরে চিকিৎসা নিতে হয় রোগীদের। এ সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীদের পকেট কাটছে। মশাকে আগে প্রতিরোধ করলে তো রোগী হাসপাতালে আসবে না। তখন চিকিৎসা ব্যয়ও লাগবে না। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, রোগীর পেছনে সরকার কতো টাকা খরচ করেছে, এটা বড় কথা নয়। মশা নির্মূলে সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে- এটাই জনগণ জানতে চায়।