তুরস্কের নির্বাচনে নির্বাহী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিয়ে বিজয়ী হয়েছে এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টির) নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এখন ‘অসীম’ ক্ষমতার অধিকারী। পশ্চিমা গণমাধ্যমে বেশ কিছু দিন ধরে তাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। রাশিয়ার সাথে তুরস্কের কৌশলগত সম্পর্ক বেশ দৃশ্যমান। এ সম্পর্ক কতটা গভীর তার একটি উদাহরণ হচ্ছে- মধ্যরাতে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সকালে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রথম টেলিফোনটি এসেছে পুতিনের কাছ থেকেই। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এরদোগানকে ‘সুলতান’ বিশেষণ বহু আগেই দেয়া হয়েছে।
লন্ডনের ইকোনমিস্ট কিংবা জার্মানের স্পাইগেলের মতো সাময়িকীতে বহুবার সুলতানদের পাগড়ি পরা এরদোগানের ছবিকে প্রচ্ছদ করা হয়েছে। সমালোচনার ধরন এমন- যেন এরদোগান উসমানীয় সুলতানদের ঐতিহ্যে ফিরে যেতে চাওয়া এমন এক প্রেসিডেন্ট, যিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় জনতুষ্টিবাদকে প্রাধান্য দিয়ে অপার ক্ষমতার মালিক হতে যাচ্ছেন। কিন্তু এরদোগান সুলতান আল জিল্লুল্লাহ নন কিংবা খলিফাতুল মুসলিমিনও নন। তুরস্কের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একজন প্রেসিডেন্ট তিনি। সমালোচনা যাই হোক না কেন, জন-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে তুরস্কের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের একক ক্ষমতার চাবিকাঠি এখন তার হাতেই। প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলোপ হয়ে যাবে। ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করবেন তিনি। মন্ত্রিসভার জবাবদিহিতাও থাকবে তার কাছে।
এরদোগানের অসীম ক্ষমতার সাথে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, বিরাট বিমানবন্দর, তার নিজস্ব জেট বিমান নিয়ে বহু কাহিনী প্রচার করা হয়েছে। সেই সাথে এবারের নির্বাচনে তিনি হেরে যাচ্ছেন, এমন ইঙ্গিত তো ছিলই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- তার দল একে পার্টি যেখানে ভোট পেয়েছে ৪২ দশমিক ০৫ শতাংশ, সেখানে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে এরদোগান পেয়েছেন ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ। তার জোটের আসন পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ৩০০ আসন পেরিয়ে ৩৪৪-এ পৌঁছেছে।
এ কথাও সত্য- ভূরাজনৈতিক নানা হিসাবে পুতিন এখন ‘এরদোগানের বন্ধু’। কিন্তু পুতিনের ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল আর এরদোগানের রাজনৈতিক কৌশল এক নয়। ভ্লাদিমির পুতিন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে ভরে, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে এবং ডাণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে রাজনীতির মাঠ আগে পরিষ্কার করেছেন। অপর দিকে, এরদোগান পশ্চিমা গণতন্ত্রের পথ বেয়ে ক্ষমতার মগডালে গেছেন। ইস্তাম্বুলের মেয়র থেকে প্রধানমন্ত্রী, এরপর প্রেসিডেন্ট। ভোটের রাজনীতির মাধ্যমেই তিনি ক্ষমতা সংহত করেছেন। পুতিনের মতো প্রহসনের নির্বাচন তাকে করতে হয়নি এমনকি উগান্ডার মতো নির্বাচন তো নয়ই। বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও নয়। এখন পর্যন্ত তার বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভোটে কোনো ধরনের কারচুপি কিংবা ভোট কেন্দ্রে তার সমর্থকদের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করা হয়নি। কিংবা কূটকৌশল করে বিরোধী নেতাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করার মতো ঘটনাও ঘটেনি।
গত এক দশকে এরদোগানকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান, দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করা, শরণার্থীর চাপ ও আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এরদোগানের নীতিকে সমর্থন দিয়েছেন। সম্ভবত, এর প্রধান কারণ- দেশটিতে আপাতত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে, বেকারত্বের হার কমেছে এবং একই সাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা ও গুরুত্ব বেড়েছে; যা তুরস্কের জনগণের মধ্যে তুর্কি খেলাফতের ঐতিহ্যের মুসলিম ভাবধারাসম্পন্ন জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর দুর্নীতিগ্রস্ত সেনাতন্ত্রের সাথে সেকুলার রাজনীতিবিদদের শিকড় চিরতরে কেটে দিয়েছেন। কথায় কথায় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অবৈধ সুযোগ তিনি আর রাখেননি। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমে সেনা হস্তক্ষেপ বন্ধের ব্যাপারে এরদোগানের পদক্ষেপ প্রশংসা পায়নি, যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জড়িতদের বিচারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ।
কিন্তু জনগণের সমর্থন নিয়ে তিনি যখন বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন, তখন পশ্চিমা বিশ্বের জন্য গণতন্ত্রের এই ‘বিষ গেলা’ ছাড়া করণীয় বেশি কিছু নেই। আর দেশটির অবস্থান এমন যে, উপেক্ষাও করা যায় না। ফলে পশ্চিমা বিশ্বকে এরদোগানের সমালোচনা যেমন করতে হচ্ছে, তেমনি তাকে নিয়েই চলতে হবে। এক সময়ের ফুটবল মাঠের এ খেলোয়াড় যেমন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভোটের মাঠের পাকা খেলোয়াড়, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুশলী খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর পুতিন যেমন রাশিয়াকে বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হাজির করেছেন, তেমনি এরদোগানও উসমানীয় খিলাফতের সুলতানদের মতো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছেন। ভুলে গেলে চলবে না যে, পারস্য ছাড়া পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তুর্কিরাই শাসন করেছে। ফলে হিজাজের বেদুইন থেকে জর্দানের হাশেমীয় গোত্র কিংবা মিসরীয় বা ফিলিস্তিনিদের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা কিংবা বেঈমানির সাথে তারা পরিচিত। আরবরা কখন কী চায়, তুর্কিরা সম্ভবত তা ভালো বুঝতে পারে। ফলে এরদোগান আবার বিজয়ী হয়ে আসায় পশ্চিমা বিশ্বের মতো অনেক আরব শাসককের বেদনা কম নয়। ফলে এরদোগানের প্রতিপক্ষ, সেকুলার রাজনৈতিক জোটকে শুধু পশ্চিমা দেশগুলো নয় সৌদি-আমিরাতি পক্ষ থেকে সমর্থন জোগানো হয়েছে। তবে এরদোগানের বিজয়ে সবচেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন কাতারের আমির। যেসব দেশের সরকারপ্রধানের কাছ থেকে প্রথম অভিনন্দন এসেছে, তার মধ্যে তিনি আছেন। কাতারের তরুণ আমির তার ভাগ্য আর এরদোগানের ভাগ্য এক সুতায় বেঁধে ফেলেছেন। একই সাথে এ বিষয়ে সবচেয়ে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের। কাতারে ক্ষমতার পরিবর্তন কিংবা দেশটিকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার যেকোনো পরিকল্পনা থেকে এমবিএসকে দূরে সরে থাকতে হবে। আগামী দিনে কাতারে মার্কিন সৈন্যদের সাথে আরো বেশি তুর্কি সৈন্য দেখা যাবে, নিশ্চিত করে বলা যায়।