তীব্র গরমের সঙ্গে দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদাও। এ অবস্থাতেই শুরু হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে লোডশেডিং বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় কোথাও ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ফলে ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে জনজীবনে। জ্বালানি সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর এতে হচ্ছে লোডশেডিং। এমনটা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার ধামরাই উপজেলার জয়নাল আবেদীন নামের এক গ্রাহক অভিযোগ করে বলেন, তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। গরম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। গত বছরও ভরপুর গরমের মৌসুমেও বিদ্যুতের লোডশেডিং সহ্য করতে হয়েছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলায় এক বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। গত ৫/৭ দিন বিদ্যুতের মারাত্মক লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ এসে মাত্র আধাঘণ্টা থাকে। বিদ্যুৎ আসে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা পর। এ ছাড়া সার্ভিসের নামে সপ্তাহে শুক্রবার বা শনিবার সারাদিন বিদ্যুৎ থাকে না।
কিশোরগঞ্জ ভৈরব উপজেলার বাসিন্দা মর্জিনা বেগম বলেন, তিন-চারবার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করলেও সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা রাত ১২টার পর থেকে। তখন ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। ময়মনসিংহ এলাকার বিদ্যৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিং পরিস্থিতি খুব খারাপ আকার ধারণ করেছে। এক সপ্তাহ ধরে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ৭০০ মেগাওয়াট। কোথাও ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি থাকছে। সামনের দিনগুলোতে আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা তার।
লোডশেডিং বাড়ার কারণ কী জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গ্যাস সরবরাহের কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যেখানে গ্যাসে ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছিল সেখানে ১৫০০ মেগাওয়াট কম উৎপাদন হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, জ্বালানির অভাবে বা আমদানি করতে না পারায় গত দুই বছর গরমের সময় লোডশেডিং বেড়েছিল। শহরের দুই থেকে তিন ঘণ্টার লোডশেডিং হলেও গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ের অভিযোগ ছিল। এবারও তেমন পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা তাদের।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের কম। বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকছে। সক্ষমতার অর্ধেকেরও কম উৎপাদন করছে অনেকগুলো কেন্দ্র। দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে না পারায় এবং জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় টাকা ও মার্কিন ডলারের জোগান না থাকায় তেল-গ্যাস-কয়লা আমদানিতে ভাটা পড়েছে। এপ্রিলে এসে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এ বছরের সামনের দিনগুলোতে গরম বৃদ্ধির সঙ্গে লোডশেডিং বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে রমজানে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। এ বছর গরমে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে প্রাক্কলন রয়েছে। জ্বালানি তথা তেল, গ্যাস ও কয়লার সরবরাহ না বাড়ালে তখন লোডশেডিংজনিত সংকট আরও বাড়বে।
পাওয়ার সেলের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৬৭ মেগাওয়াট। এটা ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ। গত বছর ১৯শে এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। দেশে বর্তমানে গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৬৬ লাখ। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী শতভাগ।
পিজিসিবি’র হিসাবে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে ১ হাজার ৮৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। সন্ধ্যা ৯টায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৭০ মেগাওয়াট। ওই সময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৫৭১ মেগাওয়াট। এ সময় ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৯৯ মেগাওয়াট। অর্থাৎ তখন গ্রাহক পর্যায়ে ১১৯৯ মেগাওয়াট বা তারচেয়ে বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদা ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৬৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দুই সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকো জানায়, সরবরাহ ঘাটতির কারণে লোডশেডিং হচ্ছে না। তবে কারিগরি ত্রুটির কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্র জানায়, তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে না। তাই বিতরণেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু স্থানে অপেক্ষাকৃত বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। চট্টগ্রামে লোডশেডিংয়ের অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের। লোডশেডিং কম বরিশাল বিভাগে।
পিডিবি’র কর্মকর্তারা বলেন, চাহিদার চেয়ে গ্যাসের সরবরাহ কম হওয়ায় গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দৈনিক অন্তত ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামাফিক গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন হচ্ছে না। বর্তমানে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৭-৮৮ কোটি ঘনফুট। গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে পেট্রোবাংলাকে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তেল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না। পিডিবির কাছে বড় অঙ্কের বকেয়া পড়েছে তাদের। ফলে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতেও খুব বেশি উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।