শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতারা বেপরোয়া আচরণ করবেন- এমন একটি ধারণা সর্বমহলে ছিল। বাস্তবিক পক্ষে হয়েছিলও তাই। কিন্তু আগের হালের মতো চলার নীতিতে বিএনপিকে ছেড়ে দিতে চাননি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত বিপ্লবের পর দেশের কোথাও কোথাও বিএনপি নেতাকর্মীদের হাতে আওয়ামী লীগ নেতা বা তাদের সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ীরা হামলার শিকার হন, দখলের কবলে পড়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি নেতাদের এমন আচরণ ছাত্র-জনতাসহ সুশীল প্রতিনিধিরা ভালোভাবে নেননি। রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিএনপির দখল-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। প্রসাশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এসবের কড়া সমালোচনার মুখে দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় সরব হন তারেক রহমান। বিএনপির ইমেজ রক্ষায় তারেক রহমান ছাড় দেননি দলের ত্যাগী সিনিয়র নেতাদেরও। দল হিসেবে বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো দখল-চাঁদাবাজি করবে না- তারেক রহমানের এমন বার্তা দলটির নেতারা মোটেও অনুধাবন করতে পারেননি। তাই দলের সিনিয়র নেতাসহ মাঠপর্যায়ের বড় একটি অংশ বহিষ্কার ও শোকজের শিকার হয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, অনেকের আশঙ্কা ছিল হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কেউ কেউ ধারণা করেছিল দখল, চাঁদাবাজি ও প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে মেতে উঠবেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তবে হাইকমান্ডের কঠোর অবস্থানের কারণে ব্যাপক মাত্রায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তারপরও বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। তবে যাদের বিরুদ্ধেই বিশৃঙ্খলা বা দখলদারত্বে জড়িত থাকার ন্যূনতম সম্পৃক্ততা পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের আইনের হাতে সোপর্দ করতে দলের পক্ষ থেকে মামলাও পরিচালনা করা হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর দমন-পীড়নের মুখে থাকা নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারেক রহমান বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। প্রতিদিনই তার বক্তব্যে নতুনত্ব ও একের পর এক বাস্তবমুখী সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত উঠে আসছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘যারাই বিএনপির নাম ভাঙিয়ে নৈরাজ্য ও অসাংগঠনিক কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূলের অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ৫ আগস্টের পর তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে একাধিকবার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। সর্বশেষ তিনি ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন; এমনকি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাও নিষিদ্ধ করেছেন। মূলত দল হিসেবে বিএনপির দাম্ভিকতা প্রকাশ পায় এমন যেকোনো কাজ থেকে বিরত থাকতে নেতাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারেক রহমানের এসব ত্বরিত পদক্ষেপ ও নেতৃত্বগুণ তার পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানেরই প্রতিচ্ছবি বলে মনে করি।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছিল। হাসিনার পতনের পর তাদের সেই ক্ষোভের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারত। কিন্তু তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশনা, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং প্রতিহিংসার পরিবর্তে সহনশীল রাজনীতির কারণে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ধৈর্যধারণ করেন। একই সঙ্গে দেশজুড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। বিশেষ করে আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীশূন্য দেশে পাড়া-মহল্লায় পাহারা দিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তারেক রহমানের সেই ভূমিকা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও তারেক রহমানের এসব পদক্ষেপকে সময়োপযোগী মনে করছেন। এককথায় বিএনপিকে তিনি গণমানুষের দলে পরিণত করেছেন। তার বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন মন্তব্য শেয়ার করছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না মর্মে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্যকে অসাধারণ, সময়োপযোগী, পরিপক্ব আখ্যা দিয়ে প্রশংসা করছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার বক্তব্য বেশ আলোচিত হয়। চায়ের দোকান থেকে গণপরিবহনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষের আলোচনায় তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন সবাই।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই তাৎক্ষণিক বিজয় বার্তায় তারেক রহমান দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বিনাভোটে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে হাজারো মানুষকে গুম, খুন ও অপহরণ করেছেন। হামলা চালিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে ঘরবাড়িছাড়া করেছেন। শেখ হাসিনার অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ। এ কারণেই গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালানোর পর নির্যাতিত-নিপীড়িতদের কারো কারো আচরণে হয়তো ক্ষোভের মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। আমি খবর পেয়েছি, দেশের কোথাও কোথাও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আমার বক্তব্য স্পষ্ট, কাউকে সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী, কেউ সংখ্যালঘু নয়। আমাদের সবার একটাই পরিচয়, আমরা বাংলাদেশি। সুতরাং ব্যক্তি হিসেবে কারো প্রতি কোনো ক্ষোভ থাকলে প্রয়োজনে আইনগত পদক্ষেপ নিন। কিন্তু আপনারা কেউ নিজ হাতে আইন তুলে নেবেন না। অনুগ্রহ করে কেউ প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না। এর আগে গত ৭ আগস্ট ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে ভার্চুয়াল বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার রক্তঝরা বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের সম্পদ ও সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষার জন্য নেতাকর্মীসহ সবাইকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান তিনি।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করছেন তারেক রহমান। গত ২৯ আগস্ট রংপুর বিভাগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু হয়। সর্বশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিভাগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আবারও শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের পরিকল্পনার কথা পুনরায় জানান। এছাড়া এ সময়ে তারেক রহমানের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় করা, চাঁদাবাজি ও অপকর্মে জড়িত থাকায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মীকে শোকজ-বহিষ্কার ও মামলা দায়ের এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া এবং অসংখ্য আহতকে চিকিৎসাসেবা দেয় বিএনপি।