আমার প্রিয় ব্যাক্তিত্ব, আমার আদর্শ-আমার মহানায়ক, স্বাধীনতার ঘোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর সাথে আমার কিছু প্রত্যক্ষ স্মৃতি, কিছু স্মরণীয় মূহুর্ত আছে…… যেমন, আমি যখন ঢাবি’র ছাত্র তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সেই বহুল আলোচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন-যা আমরা প্রতিবাদ করতে গিয়েই জিয়ার অনূসারী হয়েগিয়েছিলাম, বংগ ভবনে কৃতি ছাত্রদের সম্বর্ধনা, হিজবুল বাহার জাহাজে ইন্দোনেশিয়া-সিংগাপুর ভ্রমন…… তাঁর সফর সংগী হয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যাওয়া…… জিয়া সংশ্লিষ্ঠ বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার জন্য সব সময়ই আমার বন্ধুরা আমাকে অনূরোধ করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার তাঁকে নিয়ে যখনই কিছু লেখার চেষ্টা করি-আমি বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যাই!
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতেন। তার আমলে নিয়মিতভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান অর্জনকারীদের বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ করা হত। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজে উপস্থিত থেকে মেধাবীদেরকে সম্বর্ধনা দিতেন এবং ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম বোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন। মেধাবীদের সাথে নিয়ে হিজবুল বাহার নামক জাহাজে করে বারকয়েক সমুদ্রভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই সমুদ্রভ্রমণে সঙ্গী করা হত দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের, যাদের সংস্পর্শে এসে নবীন মেধাবীরা অনেক কিছু জানতে পারবে। হিজবুল বাহারে তিনি নিজেও নবীন মেধাবীদের সঙ্গ নিজের ভাবনাগুলো শেয়ার করতেন। আমাদের ভাবনাগুলোও গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং অনূধাবন করতেন। আজ আমি আমার মহা নায়কের সাথে হিজবুল বাহার ভ্রমনের স্মৃতিচারণ করবো।
আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এসএসসি থেকে স্নাকোত্তর পর্যন্ত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে তিনবার ভ্রমনে গিয়েছিলেন। একবার গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম থেকে সুন্দরবন। দুইবার চট্টগ্রাম-সিংগাপুর-ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমারও সেই সফরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের সাথে তিনি ৪ দিন-রাত এক সঙ্গে থেকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এ সমস্ত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার।
হিজবুল বাহারে যাত্রী বহন সংখ্যা ছিল দুই হাজার। এর মধ্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদও ছিলেন।
১৭ জানুয়ারি, ১৯৮১ইং দুপুর ১২ টার সময় হিজবুল বাহার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সুন্দর বনের সঙ্গম স্থলের অদুরে হিরণ পয়েন্ট হয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি সিংগাপুর-ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যা ৭ টা। জাহাজের ৩য় তলায় সবাই জমায়েত হয়েছেন। সেখানেই রাষ্ট্রপতি জিয়া ছাত্র-ছাত্রীদের সাক্ষাৎ দেবেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নিরাপত্তা রক্ষীদের কর্ডন ভেদ করে রাষ্ট্রপতি এগিয়ে আসছেন। সমবেত সবাই দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানালেন। তিনি হাতের ইশারায় আমাদের বসতে বললেন। আমরা বসা মাত্রই বিএনপি মহাসচিব ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মাইকটি রাষ্ট্রপতির সামনে এগিয়ে দিলেন। চোখে তাঁর রহস্যঘেড়া বিখ্যাত কালো চশমায় দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের দলটাকে কয়েকমূহুর্ত অবলোকন করে রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বভাবসূলভ সৌজন্য প্রকাশ করে বক্তৃতা শুরু করলেন।
ভরাট কন্ঠে বললেন-“শোন ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের বাংলাদেশের ডাঙা থেকে উত্তাল বে অব বেঙ্গলের মধ্যখানে নিয়ে এসেছি। সমুদ্র হল অন্তহীন পানির বিস্তার ও উদ্দাম বাতাসের লীলাক্ষেত্র। সমুদ্রে এলে মানুষের হৃদয় সমুদ্রেরমত বিশাল, উদার ও উদ্দাম সাহসী হয়ে উঠতে বাধ্য। আমি কি ঠিক বলিনি?”
আমাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সরাসরি প্রশ্ন করলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। কেউ কোনো কথা বললো না। ক্ষণকাল বিরতি দিয়ে তিনি নিজেই তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করলেন- “আমি ঠিকই বলেছি। তোমার আমার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সংকীর্ণতা ও কুপমন্ডুকতাকে পরিহার করে সমুদ্রের মত উদার ও ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী হতে হবে।“
“আমি তোমাদের কাছে এখন যে কথা বলবো তা আমাদের জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক তাগিদ। এই তাগিদকে স্মরণীয় করার জন্য আমি একটা পরিবেশ খুঁজছিলাম। আমরা এখন বঙ্গপসাগরের মাঝে। এই উপসাগরেই রয়েছে দশ কোটি মানুষের উদরপূর্তির প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত আহার্য ও মূল ভূমি ভেঙ্গে আসা বিপুল পলিমাটির বিশাল দ্বীপদেশ যা আগামী দু-তিন প্রজন্মান্তরে মধ্যেই ভেসে উঠবে। যা বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন বিন্দু সংযোজনের তাগিদ দেবে। মনে রেখো, আমাদের বর্তমান দারিদ্র, ক্ষুধা ও অসহায়তা আমাদের উদ্যমহীনতারই আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তিমাত্র। এর জন্য অন্যের চেয়ে আমরাই দায়ী বেশী।“
“আমাদের ভিটা ভাঙা পলি যেখানেই জমুক তা তালপট্টি কিংবা নিঝুম দ্বীপ এই মাটি আমাদের। দশ কোটি মানুষ সাহসী হলে আমাদের মাটি ও সমুদ্র-তরঙ্গে কোন ষড়যন্তকারী নিশান উড়িয়ে পাড়ি জমাতে জাহাজ ভাসাবে না।“
“মনে রেখো, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত চলছে। আমরা দশ কোটি মানুষ একতাবদ্ধ নই বলে শত্রুরা, পররাজ্য লোলুপ রাক্ষসেরা আমাদের পর্বপুরুষদের এই স্বাধীন জলাধিকারে আনাগোনা শুরু করেছে। তোমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়ে, দেশের দরিদ্র পিতামাতার সর্বশেষ আশার প্রদীপ, তোমাদের ওপর ভরসা করে আছে সারাদেশ, সারা জাতি। তোমরাই হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের পরাধীনতার কলঙ্ক মোচনকারী প্রত্যাশার আনন্দ-নিঃশ্বাস। ইতিহাসের ধারায় দৃষ্টিপাত করলেও তোমরা জানবে এই সমুদ্র ছিল আমাদের আদিমতম পর্বপুরুষদের নৌশক্তির স্বাধীন বিচরণভূমি। এমন কি বৌদ্ধযুগে পাল রাজাদের অদম্য রণপোতগুলো এই জলাধিকারে কাউকেই অনধিকার প্রবেশ করতে দেননি। এদেশেই জন্ম নিয়েছেন ঈশা খা, তীতুমীর,হাজী শরিয়ত উল্ল্যাদেরমত সাহসী সন্তান। সন্দেহ নেই আমাদের সেসব পর্বপুরুষগণ ছিলেন যথার্থই শৌর্যবীর্যের অধিকারী। তখন আমাদের সেসব পর্বপুরুষ ছিলেন সংখ্যায় নগণ্য। কিন্তু আমরা সারাটা উপমহাদেশ আর অসমুদ্র হিমাচল শাসন করেছি। বলো, করিনি কি?”
রাষ্ট্রপতি তাঁর সামনে উপবিষ্ট শত শত ছাত্রদের মধ্যে হঠাতই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন-“তুমি দাড়াও……”-আমি ভয়ে থতমত, কিংকর্তব্য বিমূঢ়, পাথরেরমত শক্ত হয়ে গেলাম! কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে দাড়ালাম। তিনি আবার বললেন-“কি আমাদের পূর্বপূরুষ কি আসমুদ্র হিমাচল শাসন করেননি?”
আমি মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলাম-“জ্বী স্যার করেছেন”।
আমার উত্তরের সাথে সাথে তিনি অনেকটা হুংকার দিয়ে বললেন-“আলবৎ করেছি।“
……এবার মহান নেতা সমবেতদের উপর এক দৃষ্টিতে কিযেনো দেখলেন……তিনি সমবেত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন-“তোমাদের মধ্যে কেউ কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলে?” প্রায় দুই হাজার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মোট ৬ জন হাত তুললেন-যাদের মধ্যে আমিও একজন। আমাদের সংগী ছাত্রদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র ছিলেন-এনামুল করিম শহীদ,গোলাম হোসেন, মিয়া শহিদ হোসাইন, গোলাম সরওয়ার মিলন,কাজী সিরাজ-এনারা সবাই ছাত্র দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা কর্মী এবং আমার থেকে সবাই অনেক সিনিয়র। মহানায়ক আমাকে কাছে ডাকলেন এবং সকলের উদ্দেশ্য বললেন-“তোমরা কি জানো হুমায়ুন কবির একজন মেধাবী ছাত্রই নয় একজন কিশোর মুক্তি যোদ্ধাও?”
(মেধাবী ছাত্রদের সম্বর্ধনায় আমিও আমন্ত্রিত হয়ে কয়েকবছর পূর্বে যখন বংগভবনে গিয়েছিলাম সেই সময় প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীদের সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা দেয়া হয়েছিল-সেখানে আমার কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বিশয়টা উল্লেখ করা হয়েছিল। আমি অবাক হলাম-আমারমত একজন সাধারন মানুষের ছোট্ট বায়োডাটাও কত মনোযোগ দিয়ে তিনি পড়েছেন এবং আজও মনে রেখেছেন!)
রাষ্ট্রপতি আমাকে ইংগীত করে উল্লাস প্রকাশ করে হাসলেন। তারপর নরম কন্ঠে জিজ্ঞেশ করলেন- “তুমি কি আমাদের সেই পূর্বপূরুষ বীরদের কারো নাম জানো?”
আমি বললাম- “জানি। রাজা মহীপাল, বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁ……”
রাষ্ট্রপতি আমার জবাবে চমৎকৃত হয়ে বললেন, “ইউ আর রাইট মাই সান। তুমি কি ইতিহাসের ছাত্র?”
“নো, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি পাব্লিক এডমিনেস্ট্রেশনের ছাত্র।“
রাষ্ট্রপতি জিয়া খুশীতে স্বভাব সূলভ দুইহাত উঁচুকরে হাততালি দিলেন। সাথে সাথে পুরো জাহাজ জুড়ে সবাই হাততালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দিত করলেন এবং রাষ্ট্রপতির ইংগীতে আমি বসে পরলাম।
ভাষণ আবার শুরু হলো……
“প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বজাতির মধ্যে মেধারও অভাব নেই। এই ছেলেটির কথাই ধরা যাক না। সে লোক প্রশাসনের ছাত্র কিন্তু আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য বিশয়েও সচেতন। এরাই জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। ‘শোন ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের সান্নিধ্য পেয়ে খুবই খুশি। ৫ দিন ও ৫ রাত আমরা এই দরিয়ায় নোনা বাতাসে দম ফেলতে এসেছি। এখন এই জাহাজটিই হল বাংলাদেশ। আর আমি হলাম তোমাদের ক্যাপ্টেন।“
“আমি চাই আমাদের দেশের প্রতিভাবান ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা চাক্ষুস পরিচয় ও বন্ধুত্বের আদান-প্রদান হোক। চেনা-জানা থাকলে পারস্পরিক আত্মীয়তা রচিত হয়। হয় না কি?”
সবাই আমরা এক সাথে জবাব দিলাম-“ইয়েস মিস্টার প্রেসিডেন্ট।“
আমাদের সাথে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ততকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী এস এ বারী এটি, পরিকল্পনা মন্ত্রী ড, ফসিউদ্দিন মাহতাব, ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধূরীর নাম মনে আছে। সাংবাদিকদের মধ্যে আখতার উল আলম, আহমেদ হুমায়ুন, শাহাদাত চৌধূরী, হেদায়েত হোসাইন মোর্শেদ এর কথা মনে আছে……শিল্পীদের মধ্যে আপেল মাহমুদ, আঞ্জুমান আরা বেগম, শবনম মুস্তারী অন্যতম। আমাদের ছাত্রদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখনকার তরুন শিক্ষক ডক্টর খন্দকার মোশারফ হোসেন। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সামনে আমরা, আমাদের সংগী সকলেই ছেলেমানুষ এবং ‘একান্ত বাধ্যগত ছাত্র’ অন্যদিকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদের সেই রূপকথার রাজা।
রাষ্ট্রপতি মাইকটা সরিয়ে সামনে উপবিষ্ট বাংলাদেশের মেধাবী তরুণ তরুণীদের আশা ও রোমাঞ্চে শিহরিত মুখগুলো এক নজর দেখে নিলেন। তিনি স্ট্যান্ড থেকে মাইকের মাউথপিসটা হাতে নিয়ে বললেন- “আমি তোমাদের কাছে আরও একটি গুরুত্বপর্ণ তথ্য ব্যক্ত করতে চাই-মনোযোগ দিয়ে শোনো”-
“আমাদের রয়েছে দুনিয়ার সব থেকে উর্বরা জমি। একটু পরিশ্রমেই ফসলে ঘর ভরে যেতে পারে। কিন্তু অর্থের অভাবে কোনো বৈজ্ঞানিক চাষের উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। কে আমাদের বিনা স্বার্থে এই উদ্যোগে সহায়তা করবে? কেউ করবে না। অথচ যে সম্পদের বিনিময়ে অর্থের প্রাচুর্য ঘটে তা আমাদের দেশের ভেতরেই জমা আছে। আমরা তা তুলতে পারছিনা।”
“কি সেই সম্পদ যা আমরা তুলতে পারছি না? তোমরা কি জানো সেই লুক্কায়িত সাতরাজার ধন কি? কোথায় সেগুলো আছে? সেই সাতরাজার ধন হল তেল, গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর আরও অনেক কিছু।“
আমাদের সফর সংগী সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী রিটা রহমান(মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কন্যা) প্রশ্ন করলো- ‘গ্যাস তো আমরা খানিকটা পেয়েছি। আমাদের কি তেল মানে পেট্রোল ডিজেলও আছে?
“হ্যাঁ। গ্যাস আমরা খানিকটা তুলেছি বটে। তবে এর বিপুল ভান্ডারে এখনও হাত দিইনি। গ্রামে গ্রামে জ্বালানি সরবরাহের জন্য তিতাস, বাখরাবাদের মত অসংখ্য গ্যাস কেন্দ্র দরকার। দরকার দেশের কোনো কোনো অঞ্চলের গ্যাসের পরের স্তর থেকে তেল নিংড়ে বের করে আনা।“-বেশ দৃঢ়তা ব্যাঞ্জক এক কন্ঠস্বর বেরিয়ে এল রাষ্ট্রপতি জিয়ার আবেগহীন উচ্চারণ ভঙ্গী থেকে।
এবার অন্য একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ালো।
রাষ্ট্রপতি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কিছু বলবে?”
-জ্বী স্যার,‘আমাদের কি তবে জ্বালানী তেলও আছে?’
রাষ্ট্রপতি তাঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকে হাতের ইঙ্গিতে বসতে বললেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর পাশে সিকিউরিটি অফিসার কর্নেল মাহাফুজের হাতে ধরা একটা ছোট্ট ব্যাগের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কর্নেল মাহফুজ দ্রুত ব্যাগ খুলে একটা বোতল বের করে তাঁর হাতে দিলেন। রাষ্ট্রপতি বোতলটা হাতে নিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিলেন। বোতলে ফেনায়িত হলুদ তরল পদার্থ ঝলকাচ্ছে।
“এই বোতলেই আছে বাংলাদেশের পেটের ভেতরে লুক্কায়িত সাতরাজার ধন, পেট্রোল। বিশুদ্ধ পেট্রোল। যা পুড়িয়ে বিমান, গাড়ি, অসংখ্য ভারী যানবাহন, সমুদ্রে জাহাজ অনায়াসে চলাচল করতে পারবে। শক্তির ধাত্রী এই তেল। আল্লাহ্র সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। তোমরা ভালো করে দেখে রেখো ছেলেমেয়েরা, আমার হাতের মুঠোয় রয়েছে সেই মহার্ঘ নিয়ামত যা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে, মাটির উদরে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। যা ক্রমাগত বাঁধার ফলে আমি শত চেষ্টা সত্ত্বেও তোমাদের ভাগ্য ফেরাতে তুলে আনতে পারছিনা।“
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে রাষ্ট্রপতি একটু ক্লান্ত কিম্বা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি আবেগ বিহ্বলের মত একটু পাশ ফিরে ডাঃ চৌধুরীর দিকে তাকালেন। তারপর মুহর্তের মধ্যে মুখ ফিরিয়ে শ্রোতাদের স্তব্ধতা উপলব্ধি করে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আমার জীবৎকালে সম্ভবপর না হলে তোমরা, আমার ছেলেমেয়েরা, এই তেল তুলবে।“
তাঁর কথায় একটা গভীর স্তব্ধতা নেমে এল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সাহস নেই কোনো সম্পুরক প্রশ্ন উত্থাপনের। স্তব্ধতার মধ্যে জাহাজের গায়ে ক্রমাগত আছড়েপড়া ঢেউয়ের ফোঁপানি শোনা যাচ্ছে…..
কবি আল মাহমুদ-এর নির্দেশে সাংস্কৃতিক দল জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান-“কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট, শিকল পুজার পাষাণবেদী” -দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করল।
ড্রাম তবলা ও অন্যান্য সঙ্গীত যন্তের সম্মিলিত শব্দে জাহাজ তথা আমাদের অনুষ্ঠান কেন্দ্রের গুরুগম্ভীর ভাবটা মুহর্তের মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে হঠাৎ উত্তেজনাপর্ণ হয়ে উঠলো। শ্রোতারা হাত তালি দিয়ে শিল্পীদের সাথে গলা মেলাতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রপতি নিজেও হাততালি দিচ্ছেন। এমন কি তাঁর দেহরক্ষী এবং উপস্থিত নাবিকগণও।
আমি রাষ্ট্রপতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি তালি বাজিয়ে সকলকে উৎসাহ দিচ্ছেন। কয়েকটি গান শুনে সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সেন্ট্রি সচকিত হয়ে তাঁর জন্য পথ তৈরী করলো। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। স্বাভাবিক সৌজন্যসহ তিনি তাঁর কেবিনের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
১৯ জানুয়ারি সকালে জাহাজের ক্যাপ্টেন রাষ্ট্রপতির সামনে একটি কেক নিয়ে আসেন এবং বলেন স্যার আজ আপনার জন্মদিন। আমরা আপনার জন্মদিন পালন করবো। তিনি মৌণ সম্মতি দিলেন এবং সকলেন অনুরোধে কেক কেটে তাঁর ৪৫তম জন্মবার্ষিকী পালন করলেন। এটাই তাঁর জীবনে প্রথম এবং শেষ জন্মবার্ষিকী পালন।
১৯৮১ থেকে ২০১৪ ইং দেখতে দেখতে ৩৩টি বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু আজো আমি ভুলতে পারিনি হিজবুল বাহারে রাষ্ট্রপতি জিয়া, আমার মহানায়কের দেয়া সেই আবেগময় বক্তৃতা। হয়ত কোনদিন ভুলতে পারব না।
(লেখাটি ২০১৪ সালের )
লেখকঃ হুমায়ুন কবির
ফেসবুক/ব্লগ আইডিঃ জুল ভার্ন