আগামী জুন মাসে না হলেও জুলাই মাসে বিদ্যুতের দাম আবার বৃদ্ধির চিন্তা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে অর্থবছরের শুরুতেই গ্রাহকের ব্যয়ের বোঝা আরও ভারী হবে। সঙ্গে গ্রাহককে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিও সহ্য করতে হবে গরম মৌসুমে। গ্যাস এবং ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানিতে ছন্দপতন ঘটছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে বিদ্যুতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। ভর্তুকি কমাতে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে দাম।
ইতিমধ্যে চলতি বছরে তিন ধাপে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। পাইকারিতে ২৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। যা সমন্বয়ের নামে সরকারের নির্বাহী আদেশে বৃদ্ধি করা হয়। সূত্র জানায়, এখন আবার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ থেকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধির বিষয়েও ভাবছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আবার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (পিডিবি) পাইকারি পর্যায়ে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
পিজিসিবিও বিদ্যুতের হুইলিং (সঞ্চালন) চার্জ বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। পরিস্থিতির কারণে ভর্তুকি তুলে দেয়ার চিন্তা করা হলেও এখন আপাতত তা করা যাচ্ছে না। কারণ নির্বাচন সামনে থাকায় এক লাফে বেশি দাম বাড়ানোর সুযোগ দেখছে না সরকার। এ কারণে কম করে হলেও মূল্য বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে।
এদিকে, গত সোমবার বিদ্যুৎ ভবনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বাজেট সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, নির্বাচনের বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পুরোপুরি সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, হঠাৎ করে সাবসিডি তুলে দিলে ইলেকশনের বছর বিরাট ইমপ্যাক্ট পড়বে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বহু চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত অতিবাহিত হচ্ছে। সব ধরনের জ্বালানির দাম বেড়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যবস্থা ও সঞ্চালন ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা না থাকলেও জ্বালানির অভাবে লোডশেডিং করতেই হচ্ছে। তিনি বলেন, করোনার পরপরই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। কয়লার দাম বেড়ে গেল ৬০ ডলার থেকে ৪৫০ ডলারে, গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ালো ১০ ডলার থেকে ৩৭ ডলারে, তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৬০ ডলার ছাড়িয়ে গেল।
এই ধাক্কাটা মারাত্মক একটা গ্যাপ তৈরি করে ফেলেছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে। এর মধ্যে আমরা প্রাইসিং মার্কেট-বেজড করি নাই। আমাদের টার্গেট গ্রাহকদের জন্য আমরা সাবসিডি দিয়ে যাচ্ছি। লাইফলাইন গ্রাহকরা খুব কম দামে যেন বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারে, সে চেষ্টা আমাদের ছিল। এটা এখনো চলছে। সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস চলছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরাও এর বাইরে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে এই সংকট ব্যাডলি অ্যাফেক্ট করেছে। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলতে হচ্ছে। এর মধ্যে আইপিপিগুলোর অনেক টাকা বকেয়া হয়ে গেছে। তাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। তবে হতাশার কিছু নাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আজকে আমরা কয়লা আনতে পারি নাই, কালকে আনতে পারবো।
নির্বাহী আদেশে ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে চলতি বছর গ্রাহকপর্যায়ে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে গিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে গেছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। সম্প্রতি জুনের মধ্যে আরও এক দফা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কনসালটেশন মিশনকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী চাহিদা অনুপাতে কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়লেও সংকট তো কাটছে না। বিদ্যৎ উন্নয়ন বোর্ড সমস্যা সামাল দিতে অগ্রিম টাকাও নিচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে। এমন পরিস্থিতি গ্রাহকের প্রশ্ন আর কতো বাড়বে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। আপাতত ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়ানোর পর কোম্পানিগুলোর লোকসানও হবে না, লাভও থাকবে না, তাতে সমতা পরিস্থিতিতে আসতে পারে। তখন হয়তো মূল্যবৃদ্ধির বিরতি হবে।
সূত্র জানায়, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিদ্যুতের হুইলিং (সঞ্চালন) চার্জ বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়লে তাতে হুইলিং চার্জও একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে।
ডেসকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী মানবজমিনকে বলেন, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে ১৪৭ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে। এই ক্ষতি সামলাতে বিদ্যুতের আরও ৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধি প্রয়োজন। তখন ডেসকো’র লোকসানও হবে না, লাভও থাকবে না। বিষয়টি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ও জানে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম তিন দফা বাড়ানো হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দফা এবং মার্চে এক দফা ৫ শতাংশ করে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার।
সর্বশেষ সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। যা মার্চ মাসের বিদ্যুতের বিলেই এ দাম কার্যকর হয়। এ নিয়ে গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতো এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দেশের সরকারি বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে।
গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো। দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি নিয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, আমরা অনেক আগেই বলেছি যে, ভুল পরিকল্পনা এবং নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ফলে বারবার দাম বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে। পিডিবি বারবার লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। আর পিডিবি’র দাম বাড়ানোর অজুহাতে বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়াচ্ছে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এই দফাই শেষ নয়। এ দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক অদূরদর্শী পরিকল্পনায় চলছে। যার দায়ভার পড়ছে সাধারণ জনগণের ওপর। গণশুনানি করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। এখন নির্বাহী আদেশে সরকার সরাসরি সেটা করছে। সরকার কোনোরকম জবাবদিহিতা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি করে যাচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতি আর জনগণের বোঝা দুটোই বাড়িয়ে চলেছে।
বিদ্যুতের দাম আর কতো বাড়তে পারে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন সম্প্রতি মানবজমিনকে বলেন, খুচরা পর্যায়ে ইতিমধ্যে দফায় দফায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এটা হয়তো ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর আর বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।
অন্যদিকে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছেই। শহরের চেয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ আসা- যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। রাজধানীতেই গতকালও কোথাও কোথাও ৩ থেকে ৪ চার লোডশেডিং হয়েছে। এতে প্রতিবারে প্রায় এক ঘণ্টা পরে বিদ্যুৎ এসেছে। সূত্র মতে, সারা দেশে গতকাল দুপুর ১২টায় চাহিদার তুলনায় ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল। ওই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ১৯৯ মেগাওয়াট। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটড (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তার এলাকায় গতকাল ২ থেকে ৩ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে। দুপুর ১২টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট। কিন্তু ওই সময় পাওয়া গেছে ১ হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ২২৭ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি।
এখন বিদ্যুতে আবাসিকের লাইফ লাইনে (৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য ৪ টাকা ৩৫ পয়সা দিতে হয়। আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের দাম ৪ টাকা ৮৫ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৬৩ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের দাম ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের দাম ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের উপরে দাম ১৩ টাকা ২৬ পয়সা পরিশোধ করতে হচ্ছে।